খুলনা, বাংলাদেশ | ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  দুদকের মামলায় বিএনপিনেতা আমানউল্লাহ আমানের ১৩ বছরের সাজা বাতিল করে খালাস দিয়েছেন আপিল বিভাগ
  রমনার বটমূলে বোমা হামলার মামলায় হাইকোর্টের রায় ৮ মে
  ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে ভারতের হামলার গোয়েন্দা তথ্য আছে : পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী

খুবি উপাচার্যের সহায়তায় গুম, জঙ্গি নাটকে গ্রেপ্তার করা হয় দুই শিক্ষার্থীকে !

গেজেট ডেস্ক

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনায় একটি চাঞ্চল্যকর তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। চলতি বছরের ১৭ মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে।

পাশাপাশি উপাচার্যের (ভিসি) সরাসরি জড়িত থাকারও প্রমাণ মিলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান এবং গ্রেপ্তার পূর্বপরিকল্পিত ছিল বলেও তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে শিক্ষার্থীদের হঠাৎ অন্তর্ধান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরবতা এবং পরবর্তী সময়ে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

তদন্ত কমিটিতে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. এস এম মাহবুবুর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক অধ্যাপক ড. শেখ মো. মুরছালীন মামুন, অধ্যাপক ড. মো. সফিকুল ইসলাম (তৎকালীন প্রভোস্ট, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল), অধ্যাপক শরিফ মোহাম্মদ খান (তৎকালীন প্রভোস্ট, খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ হল), অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী (ইএস ডিসিপ্লিন) এবং অধ্যাপক ড. মো. নাজমুস সাদাত (ছাত্রবিষয়ক পরিচালক)।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী নুর মোহাম্মদ অনিক ও পরিসংখ্যান ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী মো. মোজাহিদুল ইসলাম ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। এরপর ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের গুম করে রাখা হয়। দুই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের যথাক্রমে শেখ মুজিবুর রহমান হল ও খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। সে সময় তারা হলে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু তাদের নিখোঁজ হওয়ার ১৭ দিন পর গল্লামারির হাসনাহেনা নামক বাড়ি থেকে ‘আটক’ দেখানো হয়, যা তদন্ত কমিটি ‘সন্দেহজনক’ বলে অভিহিত করেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান সরাসরি এ ঘটনার বিষয়ে অবহিত ছিলেন এবং সাবেক প্রভোস্ট ড. মো. শামীম আখতার (মৃত) ও তৎকালীন কেয়ারটেকার শেখ এনামূল কবীর– এ দুজনের সহায়তায় অনিককে হল থেকে বাইরে নিয়ে গুম করা হয়।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক উপাচার্য ও গুমে জড়িত অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান ও তৎকালীন কেয়ারটেকার শেখ এনামূল কবীর পলাতক রয়েছেন।

প্রতিবেদনে তদন্ত কমিটি সুপারিশ করেছে— ওই ঘটনায় জড়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং নিরপেক্ষ বিচারিক তদন্ত। রিপোর্টে এটি ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করা হয়।

ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইতোমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সরকারের কাছে জবাবদিহি দাবি করেছে।

তৎকালীন ছাত্রবিষয়ক পরিচালক অধ্যাপক শরীফ হাসান লিমনও ঘটনাটি সম্পর্কে অবগত ছিলেন বলে প্রতিবেদনে বো হয়েছে, যদিও তিনি নিজের বক্তব্যে উপস্থিত না থাকার দাবি করেছেন। তবে ৭ জানুয়ারি গভীর রাতে উপাচার্যের বাসভবনে উপস্থিত হয়ে তিনি সিটিটিসির কাছে দুই শিক্ষার্থীকে হস্তান্তরের নির্দেশ পান– এমন তথ্যও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এই দুই শিক্ষার্থীকে গুমের পর ‘জঙ্গি’ সাজানোর অভিযোগ, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও পরিবারের বর্ণনায় উঠে এসেছে ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, তাদের দুজনকেই জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নূর মোহাম্মদ অনিক ও মো. মোজাহিদুল ইসলাম ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি সকালে হোস্টেল থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। দীর্ঘ ১৭ দিন তাদের খোঁজ না পেয়ে পরিবারের সদস্য ও সহপাঠীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তৎকালীন শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মো. শামীম আখতারের কাছে গিয়ে কেউ কোনো সদুত্তর পাননি। পরে ডিরেক্টর অব স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স (ডিএসএ) অধ্যাপক শরীফ হাসান লিমন জানান, তাদের একটি রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘জঙ্গি’ সন্দেহে তুলে নিয়ে গেছে। তবে কোথায় রাখা হয়েছে, কী অভিযোগ— তা জানাতে রাজি হননি তিনি।

নিখোঁজ হওয়ার পর তাদের পরিবারের সদস্যরা খুলনা শহরের বিভিন্ন থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গেলে পুলিশ তা গ্রহণ করেনি। এরপর ২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দাবি করা হয়, অনিক ও মোজাহিদকে তাদের বাসা থেকে ‘জঙ্গি’ হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অথচ তারা এর আগে ১৭ দিন নিখোঁজ ছিলেন, যা এই সরকারি ভাষ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

ওই ঘটনার চার বছর পর ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণআন্দোলনের আগে শিক্ষার্থীদের সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আদালত থেকে ডাকা হয়। এ সময় এহসান নেওয়াজসহ একাধিক শিক্ষার্থী আদালতে উপস্থিত হয়ে নূর ও মোজাহিদের পক্ষে সত্য সাক্ষ্য দেন। ফলে তারা দুটি মামলায় জামিন পান। তবে এর আগেই তাদের বিরুদ্ধে ৩০ বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়, যা বর্তমানে হাইকোর্টে আপিলাধীন। কিন্তু মামলাটি বছরের পর বছর শুনানির তালিকায় থাকলেও কোনো বিচারক এখনো তা শুনতে রাজি হননি।

গোপন তৎপরতা ও সিসিটিভি পর্যবেক্ষণ, গ্রেপ্তারের রাতের নাটকীয়তা

সাবেক ছাত্রবিষয়ক পরিচালক অধ্যাপক মো. শরীফ হাসান লিমন তার লিখিত বক্তব্যে জানান, দুই শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তারের কয়েকদিন আগে তৎকালীন উপাচার্য ফায়েক উজ্জামান তাকে ডেকে পাঠান এবং তার কার্যালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি দল উপস্থিত থাকে। ওই সময় বাহিনী জানায়, খুলনার বাইরে থেকে সন্ত্রাসী সন্দেহে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে এবং একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তি ক্যাম্পাসে যাতায়াত করছে— যার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক থাকতে পারে। এ সূত্রে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হলের (খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ ও তৎকালীন বঙ্গবন্ধু হল) সিসিটিভি ফুটেজ মনিটর করতে চায়।

ড. লিমনের ভাষ্যমতে, উপাচার্যের নির্দেশেই তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ওই হলে যান এবং প্রভোস্টদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি এগোয়। খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ হলের প্রভোস্ট ড. আবু শামিম আরিফ শুরুতে মৌখিক অনুমতিতে রাজি না হয়ে লিখিত অনুমতির দাবি করেন এবং উপাচার্যের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে সিদ্ধান্ত নেন। পরে ক্যাম্পাসে পুলিশ প্রবেশ এবং নজরদারির বিষয়টি বাস্তবায়ন করা হয়।

২০২০ সালের ৮ জানুয়ারির রাতে (সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে) ড. ফায়েক উজ্জামান নিজ বাসভবনে জরুরি বৈঠক ডেকে পাঠান অধ্যাপক লিমনকে। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু হলের প্রভোস্ট ড. শামিম আখতার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সেখানে বাহিনীর এক সদস্য খুলনায় দুটি বোমা হামলার তদন্তের কথা জানিয়ে বলেন, দুই শিক্ষার্থী সন্দেহভাজন এবং তাদের এখনই আটক করতে হবে।

ড. লিমন তখন ওয়ারেন্ট চেয়ে জানতে চান শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে? তিনি বলেন, ‘ওয়ারেন্ট না থাকলে আমরা কাউকে দিতে পারি না।’ উত্তরে বাহিনীর সদস্য ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘আপনারা দেশদ্রোহিতা করছেন।’ উত্তপ্ত পরিবেশে উপাচার্য পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন এবং জানান, ‘আমরা ওয়ারেন্ট ছাড়া দিব না।’ কিন্তু পরদিন সকালে জানা যায়, শিক্ষার্থীরা নিখোঁজ এবং পরে স্পষ্ট হয় যে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন।

তুলে নেওয়ার দুই সপ্তাহ পর শিক্ষার্থীদের ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এই সময়ের মধ্যে তাদের পরিবারের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে ড. লিমন যতটুকু জানেন, তা জানান। শিক্ষার্থীদের রুমমেটরা ক্যাম্পাসে তল্লাশির কথা জানান। এর কিছুদিন পর আবার ল্যাপটপ জব্দ করতে আসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যেখানে এক প্রভোস্ট দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান এবং ড. লিমনকে দায়িত্ব নিতে বলেন— যা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।

‘নাশকতার গল্প ছিল বানোয়াট’ দাবি তদন্ত কমিটিরও

তদন্ত কমিটি মনে করে, পুরো ঘটনাটি একটি সুপরিকল্পিত অভিযানের অংশ ছিল। শিক্ষার্থীদের ওপর নজরদারি, সিসিটিভি বিশ্লেষণ, গোপন বৈঠক এবং প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার মৌন সমর্থন— সব মিলিয়ে এটি স্বাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেতনাবিরোধী একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘যে ছাত্রকে ৮ জানুয়ারি হল থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে বলে বহু শিক্ষার্থী সাক্ষ্য দিয়েছে, তাকে ২৫ জানুয়ারি এক বাড়ি থেকে বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ গ্রেপ্তার দেখানো হয়— এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়।’ মোজাহিদের পরিবার ও সহপাঠীদের দাবি সে ওই বাড়িতে কখনো যায়নি, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছিল।

তদন্ত প্রতিবেদনটিতে আরো উল্লেখ করেছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং কিছু কর্মকর্তার নির্লিপ্ততা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।’

তদন্ত কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, ‘পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও আইনি জবাবদিহি নিশ্চিত না করলে, এ ধরনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ঘটনা আরো বাড়বে। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে জঙ্গি মামলা সাজানো এবং দীর্ঘ পাঁচ বছর তাকে কারাগারে আটকে রাখার ঘটনায় একটি উচ্চপর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত।’

তদন্তকারী দল জানায়, অনিককে যেখানে আটক রাখা হয়েছিল, সেটি ছিল খুলনা পুলিশ লাইন্স ও পরে বগুড়া ডিবি কার্যালয়— যেখানে তার ওপর চরম মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়।

এহসান নেওয়াজ নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই ঘটনার শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেনি। প্রভোস্ট ও ডিএসএ শুধু গা বাঁচানো উত্তর দিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করেছেন। এমনকি জিডি করতেও দেয়নি পুলিশ। পরে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে রাষ্ট্র তাদের বন্দি করে রাখে। আমি নিজে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছি, যেখানে সত্য তুলে ধরেছিলাম। এখনো তাদের মুক্তি নিশ্চিত করতে আমাদের লড়াই অব্যাহত আছে।’

এহসান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় এই গুমের ঘটনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করুক এবং একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করুক। এটি ভবিষ্যতের আইনি লড়াইয়ে সহায়ক হবে। আমরা চাই, এমন পরিস্থিতি যেন আর কোনো শিক্ষার্থীর জীবনে না আসে।’

স্বজনদের ভাষ্য ও নির্মম নির্যাতনের বিবরণ

অনিকের বাবা আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমার ছেলে সরকারবিরোধী গঠনমূলক সমালোচনা করত। তার একটি ছোট রেস্তোরাঁ ছিল ‘ফুডি ফ্যামিলি’, যেটা স্থানীয় আওয়ামী ক্যাডারদের চাঁদা না দেওয়ায় ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরপরই সে গুমের শিকার হয়। তাকে বঙ্গবন্ধু হলের প্রভোস্টের হাত ধরে তুলে দেওয়া হয়েছিল।’

নূর মোহাম্মদ অনিক নিজেও ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন তার আইনজীবীর মাধ্যমে। তিনি বলেন, ‘আমি তখন বঙ্গবন্ধু হলে ৩১২ নম্বর কক্ষে ছিলাম। সেদিন সকালে এনামুল ভাই এসে জানায়, প্রভোস্ট স্যার আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। বাইরে এসে দেখি, স্যার নিজে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি গল্প করতে করতে গল্লামারি এলাকায় সাতক্ষীরা ঘোষ ডেয়ারির সামনে নিয়ে যান। সেখানে সাদা পোশাকে পুলিশ আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। সেখান থেকেই তারা আমাকে ধরে নিয়ে যায়।’

অনিক বলেন, ‘আমার চোখ বেঁধে সারা দিন ধরে বিভিন্ন স্থানে ঘোরানো হয়। ফেসবুকে সরকারবিরোধী পোস্ট, কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন ইত্যাদি নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করা হয়। পেটের মধ্যে পিস্তল ঠেকিয়ে ভয় দেখানো হয়, মুখ ও গোপনাঙ্গে আঘাত করা হয়।’

অনিকের ভাষ্যমতে, তাকে খুলনা পুলিশ লাইন্সে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে বগুড়ার ডিবি অফিসে নিয়ে ১৭ দিন আটকে রাখা হয়। সেখানেও তার ওপর লাগাতার নির্যাতন চালানো হয়।

অনিক বলেন, ‘আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমি একজন সচেতন ছাত্র হিসেবে সরকারের সমালোচনা করতাম। আমার মতের জন্য, আমার জীবন ও শিক্ষা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাকে সাতটি মামলায় আসামি করা হয়েছে— যুবলীগ নেতার ওপর হামলা, বিস্ফোরক, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা ইত্যাদি। বগুড়ার এএসপি (পরবর্তী সময়ে সিরাজগঞ্জের এসপি। বর্তমানে বরিশাল রেঞ্জে সংযুক্ত) আরিফুর রহমান মণ্ডল তখন বলেছিল, ‘তোর সহপাঠীরা আন্দোলন না করলে তুই গুম থেকেই বের হতে পারতি না।’

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী মোজাহিদুল ইসলামের বাবা মো. রেজাউল করিম। নিজেকে তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বলেন— ‘আমার ছেলে ছাত্রশিবির করত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাসিনা সরকারের দুর্নীতি ও স্বৈরতান্ত্রিকতা নিয়ে লেখালেখি করত। সে একটি ছোট রেস্তোরাঁ চালাত, স্থানীয় আওয়ামী ক্যাডারদের সঙ্গে চাঁদা নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়। এর ফলেই পুলিশ তাকে গুম করে।’

রেজাউল করিম জানান, ছেলে তাকে জানিয়েছে, তাকে বগুড়ার পুলিশ লাইন্সে আটক রেখে অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়। ‘তাকে ক্রসফায়ারের হুমকি দেওয়া হয়, শরীরে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়, ঝুলিয়ে রাখা হয়, এমন কী কাগজে সই না করলে সারা জীবন গুম করে রাখার ভয় দেখানো হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের বিরুদ্ধে ঢাকায়, ময়মনসিংহে ও খুলনার বিভিন্ন থানায় সাতটি মামলা দেয়। যার সবই আওয়ামী লীগ অফিসে ও যুবলীগ নেতা ও পুলিশের ওপর হামলার মতো অভিযোগে।’

রেজাউল করিম আরো বলেন, ‘গুম ও গ্রেপ্তারে জড়িত খুলনার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার লুৎফর কবির, বগুড়া ডিবির পুলিশ সুপার আরিফ মণ্ডল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূরে আলম, উপপরিদর্শক জুলহাজ, ওয়াদুদ, সহকারী উপপরিদর্শক মোহন, কনস্টেবল মুজিবরসহ অন্তত ২০ থেকে ৩০ জন পুলিশ সদস্য জড়িত।’

জঙ্গি নাটকে ঘুরেফিরে আসছে বগুড়ার ইন-সার্ভিস সেন্টারের নাম

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুই শিক্ষার্থীকে ধরে নিয়ে বগুড়া পুলিশ লাইন্সের ইন-সার্ভিস সেন্টারে রাখা হয়েছিল। এই সেন্টারেই তখন ভিন্ন মতের কিংবা নিরীহ নারী-পুরুষ ধরে এনে ‘জঙ্গি বানানো’ হতো। দেশব্যাপী বিভিন্ন জঙ্গি নাটকে ব্যবহার করা হতো এই নিরীহ বন্দিদের। রাজধানীর কল্যাণপুরে জাহাজবাড়ী জঙ্গিবিরোধী নাটক, পান্থপথে হোটেল ওলিওতে তথাকথিত আত্মঘাতী বিস্ফোরণের গল্প এবং গাজীপুরের পাতারটেকে অভিযান চালিয়ে ৭ তরুণকে হত্যা সব ঘটনায় নিহত বা গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বেশিরভাগই কোনো না কোনো সময় বগুড়ার পুলিশ লাইনসের ইন-সার্ভিস সেন্টারের গোপন কারাগারে গুম ছিলেন। তথাকথিত জঙ্গিবিরোধী অভিযানের নামে গ্রামগঞ্জের চাষি, শ্রমিক, গ্রামচিকিৎসকসহ তৃণমূলের লোকদের ধরে এনে এই গোপন কারাগারে রেখে চলত মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে নির্মম নির্যাতন। কাউকে বা তথাকথিত ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হতো। এই গোপন কারাগারে পুরুষের পাশাপাশি ছিলেন অনেক নারী ও তাদের সঙ্গে থাকা দুগ্ধপোষ্য শিশু। নারীদের দিনের পর দিন গুম করে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন বগুড়ার এএসপি (পরবর্তী সময়ে সিরাজগঞ্জের এসপি) আরিফুর রহমান মণ্ডল ও তার দলবল। পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ধরতে নারীদের গুম করার জঘন্য কৌশল ব্যবহার করতেন তিনি। আর পালের গোদা ছিলেন বগুড়ার সাবেক এসপি আসাদুজ্জামান (পরবর্তী সময়ে সিটিটিসির প্রধান)। সাবেক পুলিশ প্রধান শহীদুল হকের নির্দেশে এটা গড়ে তুলেছিলেন তিনি।

তদন্তে যা উন্মোচন হলো

তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, অনিকের নিখোঁজের সময় তার রুমে কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ পাওয়া যায়নি, আর মোজাহিদের ক্ষেত্রেও প্রভোস্ট সরাসরি বা পরোক্ষভাবে তাকে পুলিশের হাতে না তুলে দেওয়ার নীতিগত অবস্থান নিয়েছেন। দুটি ঘটনায় প্রশাসনের অভ্যন্তরে পারস্পরিক বৈপরীত্য এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষায় অসঙ্গত আচরণ উঠে এসেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনা কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি কাঠামোগত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি; যেখানে জবাবদিহি ও নৈতিকতা প্রায় অনুপস্থিত।

ঘটনাটি শুধু একজন ছাত্রের জীবনের করুণ অধ্যায় নয়; বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার, পুলিশি জবাবদিহির অভাব এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততার একটি ভয়াবহ উদাহরণ। তদন্ত কমিটি ও পরিবারের দাবি অনুযায়ী, এই গুম ও সাজানো মামলার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকলে তা দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির জন্য এক গুরুতর হুমকি।

সূত্র : আমার দেশ।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!